সেন্ট্রাল জেলের করিডোর ধরে হেটে যায় যাবতজীবন সাজা প্রাপ্ত কয়েদী ঈশ্বর মাহাতো।
আগে আগে ম্যাট, থালা বাটি কম্বল নিয়ে ঈশ্বর তার পিছু পিছু। ২নং কয়েদ খানার মেঝেতে বিছানা পাতা হবে তার। চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আসা ঈশ্বর’মাহাতোর অসম্পূর্ণ জীবনের বাঁকে আরো একটি মাইল ফলক পোতা হবে আজ। সেই সাথে শুরু হবে তার যাবতজীবন কারাবাস। মাথা নীচু করে হেটে যায় ঈশ্বর। পথে কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের সন্মুখিন হয়। উৎসুক কয়েদীরা এগিয়ে আসে। জানতে চায় কি কেসে সাজা হলো তার। বউ মার্ডার না ফেলসানী কেস? ডাকাতি না চুরি? হেরোইন না ফেন্সিডিল? ইত্যাদি ইত্যাদি উদ্ভট সব প্রশ্ন........... উত্তর দেয়ার আগে পরণে সাদা খাঁদির উপর লাল ডোরা কাটা যাবতজীবন কারাদন্ডের চিহ্ন দেখে কেউ কেউ আবার কৌতুক করতেও ছাড়েনা।....এই বয়সে লাইফবয় খাইলেন চাচা? যাবতজীবন সাজাকে ওরা লাইফবয় বলে। এমনিতে বেগতিক মনের অবস্থা তার উপর কয়েদীদের প্রশ্নের ধরণ দেখে কিছুটা বিরক্ত হয় ঈশ্বর। সহসা কোন উত্তর করতে পারেনা। নীরবে হেটে যায় কোমরে লাল পেটি ওয়ালা কয়েদ সরদার ম্যাটকে অনুসরণ করে।
অত্যন্ত সৎ এবং সাদামাঠা গোবেচারা কিছিমের মানুষ। থানা পুলিশ মামলা মোকদ্দমা এ সবের কিছুই বোঝেনা। নৃগোষ্ঠি সাওতাল পাড়ায় নিতান্ত বিনম্র বসবাস। মাটি আর প্রকৃতির সাথে তার নীরব সখ্যতা। বরেন্দ্র ভূমির ধুসর লালমাটি যাদের হাতের ছোয়ায় সোনা বোনে যায় তেমনি এক সাওতাল পরিবারে জন্ম। প্রকৃতির নীবিড় বন্ধন, জীবন জীবিকার ধরণ, কিম্বা আচার আচরণে প্রকৃতই মাটির মানুষ ওরা। কোন ঝুট ঝামেলা মারপ্যাচ বোঝেনা। কিছু না পাওয়ার অভিমান কিম্বা বিলাসিত জীবনের ভোগ লালসা এর কোনটাই ওদের জীবনে নেই। ওরা হুইস্কি ব্রান্ডি চায়না, মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে পাখির মাংস আর তাড়ি খায়। বেঁচে থাকার জন্য যৎ সামান্য চাওয়া পাওয়া তাও আবার প্রকৃতি নির্ভর। তবে এর মধ্যেও যে কিছু কিছু অসঙ্গতি হয়না তা নয়। আর সে কারণেই একদিন সরল প্রাণ ঈশ্বর’মাহাতোর জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে।
প্রেম করে একই গ্রামের মালতী’হাজদা নামের একটি মেয়েকে বিয়ে করে ঈশ্বর। মালতী’হাজদা মেয়ে হিসেবে দেখতে শুনতে যেমনি কাজে কর্মেও তেমনি চৌকস। সাওতাল মেয়েদের মাঠের কাজে পারদর্শী হতে হয়। তাই বিয়ের আগে গুন বিচারে বিষয়টি প্রাধান্য পায়। মালতী’হাজদার সঙ্গে ঈশ্বর’মাহাতোর দীর্ঘ দিনের প্রণয় বাসনা পরিনামে একদিন মালা চন্দন আর ধান দুবলোর ঘট সাজিয়ে বিয়ের পিড়িতে পরিপূর্ণতা লাভ করে।
দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় একের পর এক মাইল ফলক পেরিয়ে তিন পুত্র দুই কন্যার জনক হয় ঈশ্বর’মাহাতো। স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে পরম সুখে দিন কেটে যায়। মধ্যম আয়ের সংসারে ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখ যেন ধরেনা। সুখের আতিশর্যে পরিপুর্ণ জীবনের সন্ধিঃক্ষনে এসে কেন যেন বিধি হলেন বাম। ঈশ্বর’মাহাতোর জীবনে নীরবে ঘটে যায় নিয়তির এক খেয়ালী প্রলয়। সর্ব কণিষ্ঠ কন্যা সন্তানটিকে জন্ম দেয়ার ঠিক পাঁচ বছরের মাথায় হঠাৎ স্ট্রোক করে মালতী’হাজদা মারা যায়। সেই থেকে শুরু। ঈশ্বর মাহাতোর চলমান জীবনের ধারা থোমকে গিয়ে নতুন মোড় নেয়। পত্নী বিয়োগের পর সুখের সংসার তার ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। ছেলে মেয়েরা বিয়ের পর যে যার মতো আলাদা করে নিজেদের সংসার গুছিয়ে নিতে থাকে। আপন সংসার নিয়ে তারা ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। ফলে সুখের সংসার থেকে এক সময় ঈশ্বর’মাহাতো বিচ্ছিন্ন নক্ষত্রের মতো সম্পূর্ণ একা হয়ে যায়। সাওতাল পরিবারে আয় রোজগারে পুরুষের তুলনায় মেয়েদের গুরুত্ব অনেক। তাই ঈশ্বর’মাহাতোর সংসার যেন মাঝি ছাড়া নৌকোর মতো অকুল সাগরে দিশাহীন ভাসতে থাকে। এমনি বৈরী কালের আবহে অসম্পূর্ণ সংসার জীবনে ঈশ্বর’মাহাতোর একজন গৃহকত্রীর খুব বেশী প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বিপত্নীক ঈশ্বর’মাহাতো জৈবীক প্রয়োজনের তাগিদে দুলারী’মাড্ডি নামের স্বামী পরিত্যাক্তা একজন মাঝ বয়সী মহিলাকে আবার বিয়ে করে ঘরে আনে। সাথে আগের পক্ষের দেড় বছরের এক শিশু সন্তান। সাওতালি পরিভাষায় যাকে ওরা ‘ধুকোড়বেটা’ বলে। ‘গাভীর সাথে বাছুর ফাউ’ বিষয়টা বিয়ের পূর্ব সর্তানুযায়ী ছিল বলে এ নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই তার। ভেবেছিল শূণ্য বাড়িতে ছোট্ট একটা শিশু সন্তান যদি থাকে খারাপ কেন বরং তার ভালই লাগবে। অফোটা গোলাব কুড়ির মতো সুন্দর দেখতে শিশুটি। নাম তার নিখিল’মুরমু। বাবার নাম সাকারাম’মুরমু। বাবা ওর মাকে ছেড়ে অন্য একজনকে বিয়ে করে সেখানে নতুন করে সংসার পেতেছে। পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের বিধান মতো নিখিল’মুরমুকে তার বাবার কাছেই থাকার কথা। কিন্তু দুধের শিশু তাই বেকায়দায় পড়ে শেষ পর্যন্ত নিখিলকে ওর মায়ের কাছে রাখতে বাধ্য হয় সাকারাম’মুরমু। যাই হোক স্ত্রী দুলারী’মাড্ডি আর ধুকোড়বেটা নিখিল’মুরমুকে নিয়ে ঈশ্বর’মাহাতোর নতুন সংসার ধিরে ধিরে আবার সুখ শান্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। লোকে বলাবলি করে ঈশ্বর’মাহাতোর ভাঙ্গা সংসার আবার জোড়া লাগতে শুরু করেছে। আর যাই হোক নিদেন কালে দেখা শোনার জন্য বউটাকে অন্ততঃ বেচারা পাশে পাবে। দ্বিতীয় বিয়ের জন্য সবাই তাকে সাধুবাদ জানায়।
দিন যায় মাস যায় বছর ঘুরে বছর আসে। সেই সাথে দুলারী’মাড্ডির কোলে ‘ধুকোড়বেটা’ নিখিল’মুরমুও ধিরে ধিরে বড় হয়ে ওঠে। ঈশ্বর কে নিখিল বাবা বলে ডাকে। ঈশ্বরও শাশ্বত পিতৃ স্নেহের কার্পণ্য না করে নিখিলকে নিজের সন্তানের মতো মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে নেয়। আদোর স্নেহ দিয়ে বড় করে তোলে। ধুকোড়বেটা নিখিল’মুরমু এখন আর আগের সেই দুধের শিশুটি নেই চঞ্চলমনা সুদর্শণ বালক হয়ে উঠেছে সে। তাই শেষ বয়সে নিখিলকে নিয়ে দিন কেটে যায় তার সুখ শান্তিতে।
আচানক একদিন সাকারাম’মুরমু ঈশ্বর মাহাতোর সঙ্গে অযাচিত ভাবে দেখা করে। নিখিলকে নিজ বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সাকারাম ঈশ্বরকে তাগিদ দিয়ে যায়। সাকারাম’মুরমুর কথা শুনে ঈশ্বর’মাহাতোর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেই কষ্টের কথা গুলো ঈশ্বর’মাহাতো দুলারী’মাড্ডি কে খুলে বলে।
স্বামীর কথা শুনে দুলারী’মাড্ডি বিলাপ করে কাঁদতে বসে। এতদিন যাবৎ ছেলের কোন খোঁজ খবর না রাখায় দুলারী ভেবেছিল হয়তো আর কখনো সাকারাম’মুরমু ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেনা। অথচ এতদিন পর পূত্র বিচ্ছেদের কথা শুনে দুলারী’মাড্ডি মানষিক ভাবে ভীষণ ভেঙ্গে পড়ে।
স্বাভাবিক ভাবে ঈশ্বর’মাহাতোর সংসারে আবার বৈরী মেঘের প্রদুর্ভাব ঘটে। পরিপূর্ণ জীবন ধারার গতি পথে আবারও পাহাড় সম বাধার দেয়াল এসে দাড়ায়। দুলারী’মাড্ডি কে শান্তনা দেবার মতো কোন ভাষা খুঁজে পায়না ঈশ্বর’মাহাতো। মনে মনে সংকল্প করে যা হবার হবে তবু কোন ক্রমেই নিখিলকে সে সাকারাম’মুরমুর হাতে তুলে দেবেনা। এদিকে সাকারাম’মুরমু বেশ কিছুদিন ছেলের জন্য ঘুরে ঘুরে অবশেষে ঈশ্বর’মাহাতোর কুমতলব বুঝতে পারে। লাগাতার তাগাদা দিয়েও যখন কোন কাজ হয়না তখন মনের মাঝে তার প্রতিহিংসার জন্ম নেয়। দেখে দেখে অবশেষে আইনের আস্রয় নিতে বাধ্য হয় সে। পুলিশের পরামর্শ ক্রমে মিথ্যে মামলা ঠুকে দেয় ঈশ্বর’মাহাতোর নামে। একদিন রাতের আঁধারে হঠাৎ ঈশ্বর’মাহাতোকে ‘শিশু অপহরণ’ মামলা দেখিয়ে পুলিশ থানায় ধরে নিয়ে যায়। অপহৃত নিখিল’মুরমু কে উদ্ধার করে পুলিশ সাকারামের হাতে তুলে দেয়। আর ঈশ্বর’মাহাতোকে যথাযথ ধারায় চার্জসিট দিয়ে কোর্টে সোপর্দ করে। এরপর আইন তার নিজস্ব গতিতে চলতে থাকে। আইনের হাত লম্বা হলেও পা তার নিতান্তই খোড়া! খুড়িয়ে খুড়িয়ে দীর্ঘদিন ধরে ঈশ্বর’মাহাতোর শিশু অপহরণ মিথ্যে মামলার ট্রায়াল চলতে থাকে। অর্থের বিনিময়ে ভারাটিয়া সাক্ষীরা এসে মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে ঈশ্বরকে দোষী প্রমান করার প্রয়াশ চালায়। অবশেষে বহুল প্রতিক্ষিত সেই মামলার চার্জ গঠনের দিন ধার্য্য করে আদালত।
নির্ধারিত দিনে ঈশ্বর’মাহাতো কাঠগড়ায় দাড়িয়ে হতভম্ব হয়ে যায়। চারিদিকে শুধু শিক্ষিত মানুষের ভির। মনে মনে ভাবে এরা সবাই কি তাহলে মিথ্যের বেসাতি করে? কেন তবে এই মিথ্যে মামলা? কেন এতো ঝুট ঝামেলা? ঈশ্বর’মাহাতো সে কথা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনা। যথা সময়ে মহামান্য হাকিম তাঁর এজলাসে এসে বসেন। পেশকার ঈশ্বরকে শপথ বাক্য পাঠ করাতে এগিয়ে যায়। গোবেচারা ঈশ্বর ড্যাব ড্যাব করে পেশকারের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। কাঠগড়ার কাছে এসে ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে পেশকার মন্ত্র পাঠ শুরু করেন.....বলুন : যাহা বলিবো সত্য বলিবো, সত্য বই মিথ্যা বলিবোনা........ ঈশ্বর মাহাতো পেশকারের কথা শুনে কপাল ঘুচি করে অবাক হয়ে তাচ্ছিল্যের হাঁসি হাঁসে। তারপর সরল মনের অভিব্যাক্তি প্রকাশ করে।
ইরে বাইসরে...ইটা আবার মুকে কিনে বুলছিছ তুই....? যাহা বুলিবো সত্য বুলিবো...? মু মিছা কোথা বুলবো কিনে....মুতো কুনো মিছা কোথা বুলবেক লাই....তুরাই তো মুকে মিছা মামলা দিয়ে ইখানে লিয়ে আনলি....আবার মুকেই বুলছিছ মিছা কোথা না বুইলতে....? আচ্ছা মুকে লিয়ে তুরা ইতো হুড়ং ভুড়ং করছিছ কিনে ছেটাই আগে বুলবিক তো বটে.......? ঈশ্বর’মাহাতোর কথা শুনে আদালতে উপস্থিত সবাই হো হো করে হাঁসে। মহামান্য আদালত অর্ডার অর্ডার বলে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে তিনিও একটু নড়েচড়ে বসেন। তারপর বাদী পক্ষের কৌশলীকে জেরা করার অনুমতি প্রদান করেন। অনুমতি পেয়ে বাদী পক্ষের উকিল এগিয়ে যায় ঈশ্বর’মাহাতোর কাছে। সরাসরি প্রশ্ন করে............ নিখিল’মুরমু কে আপনি অপহরণ করেছেন। তাকে আপনার বাড়িতেই পাওয়া গেছে...সত্যি কিনা বলুন ? ঈশ্বর’মাহাতো আবার কপাল ঘুচি করে জানতে চায়........ তুর কোথা মু বুঝলাম লাইকো ......তুবে ইটা বুঝতে পারলাম নিখিলকে মু চুরি কর্যা আনলাম নাকি কুথায় পাইলাম তুই ইটাই জানতে চাইলি তো বটে................? ঈশ্বরের কথা শুনে উকিল আশ্বস্ত হন এবং মাথা নেড়ে সম্মতি জানান। হ্যা হ্যা সে কথাই বলুন, নিখিল’মুরমু কি করে আপনার বাড়িতে এলো সে কথাই আদালত জানতে চায় বলুন............. এবার মাথাটা তুলে চাপা ধরণের একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ঈশ্বর। তারপর আবেগ আপ্লুত হয়ে ঘটনার বিবরণ দেয়...........
তুরা ছুনবি যেখুন তাইলে ছুনেক...................... সাকারাম’মুরমু কে তো তুরা ছব্বাই চিনিছ বটে.....? ঐ সাকারাম’মুরমুর আগের মাগীটা আছেনা?......দুলারী’মাড্ডি তার নাম। মাগীটাকে সাকারাম’মুরমু যেখুন ছেড়্যা দিলো....সেখুন মু ওকে বিহ্যা কর্যা. মুর ঘোরে লিয়ে আছলাম.....নিখিল’মুরমু কে দুলারী মাগীটা ‘ধুকোড়বেটা’ কর্যা. মুর ঘোরে লিয়ে আনলো। তারপর ধুকোড়বেটা কে মু মানুছ করলাম............
এটুকু বলতেই হঠাৎ মহামান্য আদালত অর্ডার অর্ডার বলে উকিলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানতে চাইলেন ‘ধুকোড়বেটা’ শব্দটা বুঝা গেলনা। শব্দটার সঠিক ব্যাখ্যা দিন ? বাদী পক্ষের উকিল ঈশ্বর’মাহাতোর নিকট মহামান্য আদালতের প্রশ্নটা তুলে ধরে ধুকোড়বেটার ব্যাখ্য চাইলেন ............ ঈশ্বর’মাহাতো আবার তাচ্ছিল্যের হাঁসি হেঁসে মহামান্য হাকিমের দিকে তাকায়। তারপর প্রাঞ্জল ভাষায় ধুকোড়বেটার ব্যাখ্যা দিয়ে মহামান্য হাকিমকে বুঝাবার চেষ্টা করে। ধুকোড়বেটা কাকে বুলে বুঝলি লাইরে হাকিম................? আচ্ছা আচ্ছা বুলছি তাইলে ছুন......“ মুনে কর তুর মায়ের ছাথে মুর বিহ্যা হইলো......তুর মা তুকে হাতে লিয়ে মুর ঘরে আইলো.....এখুন তুই হইলি মুর ধুকোড়বেটা।“.....ইবার বুঝলি তো রে হাকিম ধুকোড়বেটা কাকে বুলে........?
ঈশ্বর’হাজদার কথা শুনে আদালতে উপস্থিত সবাই পুনরায় জীভকেটে কোন রকমে হাঁসি সম্বরণ করে ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে সলজ্জে মহামান্য হাকিমের দিকে তাকিয়ে থাকে। আসামীর বেপরোয়া কথা শুনে মহামান্য হাকিম কিছুটা বিব্রত বোধ করেণ। অতঃপর বিরোক্ত চিত্তে জানতে চান..............
এবার বলুন এই মামলায় আপনি নিজেকে দোষী না নির্দোষ মনে করেণ...........? ঈশ্বর’মাহাতো আবার বোকা বোকা দৃষ্টিতে মহামান্য হাকিমের দিকে তাকায়। বুক ভরে শ্বাস নেয়.......তারপর মাথাটা নীচু করে। এ সময় সাক্ষী গনের মিথ্যা সাক্ষীর কথা তার মনে পড়ে যায়।
সাক্ষীরা অর্থের লোভে মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে গেছে। তবে সে জন্য তার কোন দুঃখ নাই। কিন্তু এত সব শিক্ষিত মানুষ, জজ ব্যারিষ্টার, উকিল মুক্তার থাকতে সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে মিথ্যার জয় হবে একথাটা সরল প্রাণ ঈশ্বর’মাহাতো কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা। কেননা সত্যের জয় হবেই হবে এটা তার আত্মবিশ্বাস প্রসুত ধারণা।
তার উকিলের শেখানো কথা গুলো আত্মবিশ্বাসের তাড়নায় সে গুলিয়ে ফেলে। অভিমান মাখা ঠুনকো আবেগের বশে ঈশ্বর’মাহাতোর মাথাটা মূহুর্তে এলোমেলো হয়ে যায়। ফ্যাল ফ্যাল করে সে চেয়ে থাকে মহামান্য হাকিমের মুখের দিকে। মহামান্য হাকিম আবার তাকে জিজ্ঞেস করেন........বলুন আপনি দোষী না নির্দোষ......? এবার আস্তে করে নীচু মাথাটা টেনে তোলে ঈশ্বর.......মহামান্য হাকিমের মুখের দিকে ফের বোকা বোকা চোখে তাকায়। তারপর অভিমান মাখা সুরে বলে......তুরা ছব্বাই যখুন বুলছিছ মু দোছ কুরেছি......সেখুন মু আর কিছুই বুলবেক লাইরে হাকিম......তুরা ছব্বাই ছিক্ষিতো মানুছ আছিছ আর মু তো মুক্কু সুক্কু মানুছ......তুরা যখুন বুলছিছ মু দোছ করেছি........ছেখুন তো মু দোছি...................
ঈশ্বর’মাহাতোর কথা শুনে তার উকিল হতবাক হয়ে যায়! দোষ সীকার না করার জন্য ইতিপূর্বে তাকে হাজার বার নিষেধ করা সত্তেও সেই ভুলটিই সে আবেগের তাড়ণায় করে বসে। ৩৪২ ধারা মতে আসামীর স্বীকারোক্তি শুনে মহামান্য হাকিম ঈশ্বরের সহজ সরল মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। চোখ নামিয়ে নথীতে খচখচ করে কিছু লিখলেন। অতঃপর সন্তর্পণে তিনি এজলাস থেকে নেমে চলে যান। স্বীকারোক্তির পরিনাম কি হতে পারে সে কথা ঈশ্বর’মাহাতো না বুঝলেও উকিল তার ঠিকই বোঝে। পরিনামের কথা ভেবে কপাল চাপড়ান তিনি। দোষ স্বীকার না করলে হয়তো সাজা তার অনেক কম হতে পারতো। হতভাগ্য ঈশ্বর’মাহাতোকে উন্মাদ আখ্যা দিয়ে এবং তার নিয়তিকে দায়ী করে উকিল মাথা নীচু করে কোর্ট থেকে বেরিয়ে যান। পরের দিন স্বীকারোক্তি মুলক জবানবন্দি সহ সাক্ষী গনের সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে সন্দেহাতীত ভাবে অভিযোগ প্রমানিত হওয়ায় মহামান্য আদালত ফৌজদারী দন্ডবিধির ধারা অনুসারে ঈশ্বর’মাহাতোকে যাবতজীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে রায় প্রদান করেণ।
সেন্ট্রাল জেলের মেঝেতে পাতা বিছানায় মাথার নীচে হাত দুটো রেখে চিত হয়ে শুয়ে অসম্পূর্ণ জীবনের পরিনতির কথাই এতক্ষণ ভাবছিল ঈশ্বর’মাহাতো। সামনের দিন গুলোর কথা ভেবে এবার মনে মনে নিয়তিকে প্রশ্ন করে। সত্তর বছর বয়সে পারবে কি সে নতুন করে যাবতজীবন কারাদন্ডের অপূর্ণ মেয়াদ পূর্ণ করতে.......?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোজাম্মেল কবির
ঈশ্বর’মাহাতো চরিত্রটি এবং সাঁওতালদের জীবনাচরণ চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন। ওরা এমনই সরল মনের হয়। নিজের পরিনতির কথা জেনেও এমন আবেগী আচরন করে। অনেক ধন্যবাদ আনিস ভাই সুন্দর গল্প উপহার দেয়ার জন্য।
বশির আহমেদ
আদি জনগোষ্টিদের নিয়ে তেমন একটা কেউ লিখে না ্ তাদের জীবন মান তাই আমাদের কঝে অনেকটা অজানাই থেকে যায় । আপনার লেখায় সাওতালদের জীবনের সুখ দু:খ নিয়ে লেখা দারুন উপভোগ করলাম ্ সুন্দর গল্পের জন্য ধন্যবাদ ।
এস, এম, ইমদাদুল ইসলাম
কী আর করা, আসলেই মানুষ বড় একা । দোষ স্বীকার করে ঈশ্বর’মাহাতো হয়তো তার সেই একাকীত্বকেই শেষতক বেছে নিল । ভাবনাটা বেশ ভাল লেগেছে ।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।